বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৮:৪৬ পূর্বাহ্ন

প্রত্নত্ববিদ’র রিপোর্টেই অযোধ্যার রায়….?

প্রত্নত্ববিদ’র রিপোর্টেই অযোধ্যার রায়….?

বিবিসি বাংলা,দিল্লি: সদা হাসিমুখ ভদ্রলোকের পুরো নাম কারিঙ্গামান্নু কুঝিয়ুল মুহাম্মদ। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনরা অবশ্য তাকে ‘কেকে’ নামেই ডাকেন। কেরালার উত্তরপ্রান্তে কালিকটের বাসিন্দা তিনি, ভারতের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ বা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ছেষট্টি বছরের প্রৌঢ় এখন সেখানেই দিন কাটাচ্ছেন। এখনও মাঝে মাঝে অবশ্য উৎসাহী পর্যটকদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, হাম্পি থেকে বটেশ্বর-ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নানা আর্কিওলজিক্যাল সাইটে তাদের নিয়ে ‘গাইডেড ট্যুর’ করান। আর এ কাজে তার রীতিমতো ‘হাই-প্রোফাইল’ অভিজ্ঞতা আছে-মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন বছরকয়েক আগে ভারত সফরে এসেছিলেন, দিল্লির বিভিন্ন প্রতœকীর্তিতে তার ‘ট্যুর গাইড’ও ছিলেন কেকে মুহাম্মদ।
তারও বহু আগে পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ যখন আগ্রা সফরে এসেছিলেন, তাকেও তাজমহল ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল এই প্রতœতত্ত্ববিদের ওপর। কিন্তু এখন সহসা সারা ভারত জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি-আর তার পেছনে আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে কর্মরত অবস্থায় তার নেতৃত্বে প্রস্তুত করা একটি রিপোর্ট।
অযোধ্যার বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানে মন্দির বানানোর পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে, তার পেছনে এই প্রতœতাত্ত্বিক রিপোর্টটির গুরুত্ব ছিল বিরাট। মূলত: ওই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা মেনে নিয়েছেন, বাবরি মসজিদের স্থাপনার নিচেও বহু পুরনো আর একটি কাঠামো ছিল-যেটি ‘ইসলামি ঘরানায়’ নির্মিত নয়। বস্তুত: ওই রিপোর্টেই প্রথম স্পষ্টভাবে দাবি করা হয়েছিল, বাবরি মসজিদ চত্ত্বরে মসজিদ প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ত্ব ছিল। সেই জন্যই রায় ঘোষণার পর তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কে কে মুহাম্মদ বলতে দ্বিধা করেননি, “এটা একেবারে পারফেক্ট জাজমেন্ট। আমার মতে এর চেয়ে ভাল রায় আর কিছু হতেই পারে না!”
মন্দির বানানোর রায়ের মধ্যে দিয়ে তার দীর্ঘদিনের প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা ও পরিশ্রমই স্বীকৃতি পেল, সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু একজন মুসলিম হয়েও তিনি কীভাবে অযোধ্যার বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানে মন্দির ছিল বলে আজীবন সওয়াল করে এসেছেন, তার জন্য নিজের সমাজের লোকজনের কাছ থেকে বহু অপবাদও শুনতে হয়েছে। “চিরকাল আমাকে এজন্য নানা গালিগালাজ শুনতে হয়েছে। আবার এটাও বলব, কোনও কোনও মুসলিম কিন্তু প্রকাশ্যেই আমাকে সমর্থন করেছেন।” “এমন কী, খোদ লখনৌতেও আমি বহু মুসলিমের সাপোর্ট পেয়েছি”, জানাচ্ছেন কে কে মুহাম্মদ। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদকে ঘিরে যে পরিসর, সেখানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রতœতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছিল ১৯৭৬ সালে। তখন সেই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ভারতের বিখ্যাত প্রতœতাত্ত্বিক ড: বি বি লাল, তার অধীনেই একজন তরুণ গবেষক হিসেবে যোগ দেন কে কে মুহাম্মদ। তার বয়স তখন সবেমাত্র কুড়ির কোঠায়, ইতিহাসে মাস্টার্স করে সদ্যই বেরিয়েছেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে।
বাবরি মসজিদ চত্ত্বরে সেই খোঁড়াখুড়িতেই ‘মন্দির প্রণালী’, ‘অভিষেক জল’ বা ‘মগর (কুমীর) প্রণালী’র মতো বিভিন্ন চিহ্ন বা স্মারক মিলেছিল বলে জানাচ্ছেন তিনি, যেগুলো থাকত হিন্দুদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে। “কুমীর প্যাটার্নের ওই ধরনের স্থাপনা কখনও মসজিদে থাকত না।” “তা ছাড়া মানুষ ও পশুপাখির বহু টেরাকোটা মোটিফও আমরা পেয়েছিলাম, যেগুলো মুঘল আমলের কোনও মসজিদে কখনওই দেখা যেত না”, ভারতের রিডিফ ডটকম পোর্টালকে এদিন বলেছেন কে কে মুহাম্মদ। পরে এই সব ‘সাক্ষ্যপ্রমাণে’র ভিত্তিতেই ভারতের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ তাদের রিপোর্টে এই উপসংহারে পৌঁছয় যে বাবরি মসজিদ স্থাপনারও অনেক আগে সেখানে হিন্দুদের একটি মন্দির ছিল। সেই রিপোর্টেরই মূল প্রণেতা ছিলেন কে কে মুহাম্মদ। তিনি পরে উত্তর ভারতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা হিসেবে অবসর নেন। তবে সেই প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর, ভারতের অনেক বিশেষজ্ঞই ওই রিপোর্টের বিষয়বস্তু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যদিও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা রিপোর্টটিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। কে কে মুহাম্মদ জানাচ্ছেন, “ইরফান হাবিবের মতো বামপন্থী ইতিহাসবিদরা তখন খুব প্রভাবশালী ছিলেন।”
“ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিকাল রিসার্চে তখন তিনি ও তার মতো বাম ঘরানার লোকজনেরই দাপট, ফলে তারা আমাদের গবেষণাকে একেবারেই গুরুত্ব দেননি । কিন্তু এতদিন বাদে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যে তাদের ওই রিপোর্টটিকে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দিল ও সেটির ভিত্তিতেই রায় ঘোষণা করল, তাকে জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ সম্মান’ বলেই মনে করছেন কেকে মুহাম্মদ। প্রতœতত্ত্বে অবদানের জন্য এ বছরই ভারত সরকার তাঁকে বেসামরিক খেতাব পদ্মশ্রীতে ভূষিত করেছে, রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ তাঁর হাতে সেই সম্মান তুলে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর থেকেই ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে কে কে মুহাম্মদকে নিয়ে তুমুল চর্চা ও তর্কবিতর্কও শুরু হয়ে গেছে। অনেকে যেমন ওই অযোধ্যা রিপোর্টের জন্য তার ভূয়সী প্রশংসা করছেন, তেমনি অনেকের কাছ থেকে নিন্দামন্দও জুটছে। ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা। যাতে বলা হচ্ছে, “বৈচিত্র্যের মধ্যে এই ঐক্যটাই ভারতের সৌন্দর্য! এ জিনিস শুধু ভারতেই সম্ভব!” “একজন হিন্দু আইনজীবী (রাজীব ধাওয়ান) এদেশে মসজিদের জন্য প্রাণপণ সওয়াল করেন!” “আবার একজন মুসলিম প্রতœতত্ত্ববিদ (কে কে মুহাম্মদ) মন্দিরের পক্ষে রিপোর্ট লিখতেও ভয় পান না!”

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877